#### অদ্ভূত মেয়েটি ###


 ### **অদ্ভুত মেয়েটি**


শ্যামলির ছোট্ট গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা, যেখানে পাহাড় আর সবুজ বনানীর মধ্যে মেঘেরা খেলা করে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে এই গ্রাম যেন শান্তির ঠিকানা। তবে এই গ্রামের মধ্যেই ছিল এক গভীর রহস্য, যা বহু বছর ধরে মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। গ্রামটির প্রাচীন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকা এক মেয়ের গল্প—যাকে গ্রামের মানুষরা "অদ্ভুত মেয়ে" বলে চিনত। তার নাম ছিল মীনা।


#### **মীনার আগমন**


মীনার আগমন হয়েছিল হঠাৎ করেই। এক বর্ষার দিনে, যখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল, তখন গ্রামের বাইরে থাকা পুরনো পাথরের মন্দিরের পাশে তাকে প্রথম দেখা গিয়েছিল। সে ছিল একেবারেই ভেজা, তার গায়ে সাদা পোশাক, চুলগুলো এলোমেলো। গ্রামের মানুষ তাকে আশ্রয় দিয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল সে হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছে বা কেউ তাকে ফেলে গেছে।


কিন্তু মীনাকে নিয়ে গ্রামের মানুষজনের মনে অদ্ভুত কিছু কৌতূহল আর সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। কারণ সে কখনই নিজের পরিচয় দিত না। কেউই জানত না সে কোথা থেকে এসেছে, তার পরিবার কোথায়। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা, এবং তার হাসিতে লুকিয়ে ছিল কোনো গভীর রহস্য।


#### **রহস্যময় আচরণ**


মীনার আচরণ খুবই অদ্ভুত ছিল। সে দিনে খুব কম কথা বলত, প্রায় সময়ই মন্দিরের পাশের গাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকত। তবে রাতের বেলা, সে কখনও গ্রামের একদম শেষ প্রান্তের পুরনো ভাঙা বাড়িটার দিকে চলে যেত। ওই বাড়িটা বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ছিল, ওই বাড়িতে কোনও আত্মা বাস করে। তাই সবাই বাড়িটা এড়িয়ে চলত।


কিন্তু মীনা যেন ভিন্ন ছিল। সে প্রায় প্রতি রাতেই ওই বাড়ির কাছে চলে যেত, এবং সেখানে বসে একা একা কিছু ফিসফিস করে বলত। কেউ কখনও বুঝতে পারত না, সে কার সাথে কথা বলে বা কেন ওই ভাঙা বাড়ির দিকে এত আকৃষ্ট। গ্রামের বয়স্ক মানুষজন বলত, "এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কোনও অশুভ শক্তির সাথে যুক্ত।"


#### **গ্রামের অশান্তি**


দিন যতই গড়াতে লাগল, গ্রামের মধ্যে অশান্তি শুরু হলো। গ্রামের পশু-পাখিরা আচমকা মারা যেতে লাগল। অনেক বাড়িতে রাতে দরজা-জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যেত। মানুষেরা মীনার দিকে আঙুল তুলতে শুরু করল। সবাই বলত, "মেয়েটার আগমনের পর থেকেই এসব ঘটছে।"


কিন্তু কেউই প্রমাণ করতে পারছিল না, মীনার সঙ্গে এসব ঘটনার সরাসরি সম্পর্ক আছে কিনা। গ্রামে কোনও পুরোহিত বা তান্ত্রিককে ডেকে আনা হলেও, তারা কেউ মীনাকে স্পর্শ করতে সাহস করেনি। তারা সবাই মীনার ভেতরে অদ্ভুত কিছু শক্তি অনুভব করত, কিন্তু সেটা কী, কেউই ঠিক বলতে পারত না।


#### **কুসংস্কারের আক্রমণ**


এক রাতে, গ্রামের কয়েকজন যুবক ঠিক করল, তারা মীনাকে ওই পুরনো বাড়িতে অনুসরণ করবে। তারা মনে করেছিল, মীনা হয়তো কোনও অশুভ আত্মার সাথে যুক্ত। সেই রাতে পূর্ণিমার আলো ছিল, আর গ্রামের লোকজন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। যুবকরা মীনার পিছু নিল।


মীনা তার স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সেই পুরনো বাড়ির দিকে হাঁটছিল। যুবকরা ধীরে ধীরে তার পেছনে যাচ্ছিল। তারা দেখল, মীনা বাড়ির কাছে পৌঁছে সেখানে বসে কিছু বলতে শুরু করল। কিন্তু মীনার কণ্ঠস্বর এত মৃদু ছিল যে তারা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই, এক প্রবল ঠান্ডা বাতাস তাদের দিকে ধেয়ে এল। যুবকদের শরীরে কাঁপন ধরল, এবং তারা মীনাকে দেখার সাহস হারিয়ে পালিয়ে গেল।


#### **অতীতের ছায়া**


গ্রামে এই ঘটনাগুলোর পর, মীনা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লোকেরা তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। কেবল গ্রামের প্রবীণ এক মহিলা, নাম তার সরলা দিদি, মীনাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। সরলা দিদি ছিলেন গ্রামের পুরনো লোকদের একজন, এবং তিনি অনেক কাহিনী জানতেন।


একদিন সরলা দিদি মীনাকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং তার অতীতের কথা জিজ্ঞেস করলেন। মীনা প্রথমে কিছু বলল না। তবে কিছুক্ষণ পর, সে সরলা দিদিকে তার কাহিনী শোনাল। 


মীনা বলল, "আমি আসলে এই গ্রামেরই মেয়ে। কিন্তু আমার জন্ম হয়েছিল বহু বছর আগে। আমার পরিবারের সবাই মারা গেছে, আর আমাকে সবাই ভুলে গেছে। তবে আমার আত্মা এখনও মুক্তি পায়নি। আমি প্রতি রাতে ওই পুরনো বাড়ির দিকে যাই, কারণ সেখানে আমার পরিবারের স্মৃতি লুকিয়ে আছে। আমি সেই স্মৃতির কাছে ফিরে যাই, কারণ ওটাই আমার অস্তিত্বের শেষ আশ্রয়।"


#### **মীনার সত্য**


সরলা দিদি মীনার কাহিনী শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন, মীনা কোনও সাধারণ মেয়ে নয়। সে হয়তো মৃত, কিন্তু তার আত্মা এখনও এই পৃথিবীতে আটকে আছে। তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় আর হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে এভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে।


মীনা আরও বলল, "আমার পরিবারের সবাইকে এই গ্রামবাসীরাই মেরে ফেলেছিল। তাদের অপরাধ ছিল শুধুমাত্র, তারা সমাজের প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আমি আবার ফিরে এসেছি। আমি শান্তি পাব না, যতক্ষণ না সত্য প্রকাশ হয়।"


#### **শেষ সিদ্ধান্ত**


সরলা দিদি মীনাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তিনি বুঝলেন, মীনাকে মুক্ত করতে হলে এই গ্রামের ইতিহাসের সেই অন্ধকার অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। সরলা দিদি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি গ্রামবাসীদের মীনার কাহিনী শোনাবেন এবং তাদের নিজেদের ভুল স্বীকার করতে বলবেন।


পরের দিন সরলা দিদি গ্রামের প্রধানদের ডেকে বললেন, "তোমরা এতদিন ধরে যে মেয়েটিকে অপমান করেছ, সে এই গ্রামেরই অংশ। তার পরিবারকে তোমরা ভুলে গেছ, কিন্তু তার আত্মা এখনও বেঁচে আছে। যতক্ষণ না তোমরা সেই অন্যায়ের শাস্তি স্বীকার করো, মীনার আত্মা মুক্তি পাবে না।"


#### **মুক্তি**


গ্রামের লোকজন সরলা দিদির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল, মীনাকে অপমান করা মানে নিজেদের অতীতের মুখোমুখি হওয়া। অবশেষে, গ্রামের প্রধানরা মীনাকে সম্মান জানিয়ে তার পরিবারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করল। 


মীনা সেই রাতেই আবার বটগাছের নিচে দেখা গেল। তবে এবার তার চোখে ছিল শান্তি। সে মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকাল, আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পূর্ণিমার আলোয়। 


মীনার আত্মা অবশেষে মুক্তি পেল, আর শ্যামলি গ্রামে আর কখনও সেই অদ্ভুত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি। গ্রামের মানুষরা শিখল, অতীতের অন্যায় কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ