রহস্যময় নারী
### **রহস্যময় নারী**
ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটির নাম শ্যামলী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রামটির প্রতিটি ঘর যেন পাহাড়ের বুকে বসে থাকা কোনো ছবি। কিন্তু গ্রামের মানুষদের মধ্যে কিছু দিন ধরে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছিল। কারণ, তারা প্রায়ই গ্রামের প্রান্তে থাকা পুরনো বটগাছের নিচে এক রহস্যময় নারীকে দেখত।
কেউ জানত না, এই নারী কে। কেউ দেখেনি তাকে গ্রামে থাকতে। শুধু রাতের নির্জনতায়, পূর্ণিমার আলোয়, বটগাছের তলায় তাকে দেখা যেত। তার সাদা পোশাক আর ভুতুড়ে রূপ গ্রামের মানুষদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। গ্রামের প্রবীণরাও বলত, এই নারী হয়তো কোনো প্রেতাত্মা বা অভিশপ্ত আত্মা, যে কোনো কারণে এখানে এসেছে।
### **নতুন আগন্তুক**
সেই সময় গ্রামে একজন নতুন আগন্তুক এসেছিল—নাম ছিল অদিতি। অদিতি শহর থেকে এখানে এসেছে গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে। শহরের এক প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা হওয়ার কারণে পুরনো গ্রন্থ আর কিংবদন্তির প্রতি তার আগ্রহ ছিল অসীম। শ্যামলী গ্রামের পুরনো ইতিহাস তাকে এখানে টেনেছিল। কিন্তু অদিতি এসে গ্রামের লোকজনের মধ্যে প্রচলিত রহস্যময় নারীর গল্প শুনে অবাক হয়ে গেল।
অদিতির কৌতূহল বেড়ে গেল। সে ঠিক করল, রহস্যটা উদ্ঘাটন করতে হবে।
### **প্রথম সাক্ষাৎ**
এক রাতে, পূর্ণিমার আলোয় অদিতি একা গ্রাম থেকে বেরিয়ে বটগাছের দিকে হাঁটতে লাগল। চারদিক নিস্তব্ধ, গাছের পাতা থেকে মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে মৃদু আওয়াজ আসছিল। বটগাছের নিচে পৌঁছে অদিতি অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই, হঠাৎ করেই ঠান্ডা বাতাস তার চারপাশে বয়ে গেল। বাতাসের মধ্যে একটা শীতল অনুভূতি ছিল।
তখনই সে তাকে দেখল—সাদা শাড়ি পরা একজন নারী, যার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে, আর চোখ দুটো যেন এক গভীর শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। অদিতি কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। নারীটি যেন মাটির ওপরে ভাসছে।
অদিতি সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কে? এখানে কেন আসো?"
নারীটি কোনও শব্দ করল না। তার ঠোঁটে মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠল। তারপর হঠাৎ করেই নারীটি নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল।
### **প্রতিশ্রুতির আবেশ**
অদিতি পরদিন গ্রামের এক বৃদ্ধার কাছে গেল, যার নাম ছিল মধুমতী। মধুমতী বলল, "অনেক বছর আগে, এই গ্রামের জমিদারের মেয়ে মীরা ছিল খুবই সুন্দরী। কিন্তু তার জীবন ছিল দুঃখে ভরা। জমিদারের মেয়ে হয়েও সে ভালোবাসা পায়নি। গ্রামের এক দরিদ্র ছেলের সাথে তার প্রেম ছিল, কিন্তু সমাজ তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। একদিন, মীরার প্রিয় মানুষটিকে সবাই মিলে মেরে ফেলে। সেই শোকে মীরা আত্মহত্যা করে।"
বৃদ্ধা আরও বলল, "মীরার আত্মা এখনও শান্তি পায়নি। সে প্রতি পূর্ণিমায় বটগাছের নিচে আসে, তার প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায়।"
### **রহস্যের সমাপ্তি**
অদিতি এবার বুঝল, সেই রহস্যময় নারী মীরা ছাড়া আর কেউ নয়। তার আত্মা এখনও প্রতিশোধ আর ভালোবাসার ক্ষত নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদিতি সিদ্ধান্ত নিল, সে মীরার আত্মাকে মুক্ত করবে।
পরের পূর্ণিমার রাতে, অদিতি আবার বটগাছের নিচে গেল। এবার তার হাতে ছিল মীরার প্রিয় মানুষের একটি স্মৃতিচিহ্ন, যা সে মীরার পুরনো ঘর থেকে খুঁজে পেয়েছিল।
নারীটি আবারও এল, অদিতির সামনে। অদিতি সেই স্মৃতিচিহ্নটি তার সামনে তুলে ধরল। মীরার চোখের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত পরিবর্তন এল। তার চোখে শান্তির আলো দেখা গেল, আর ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে গেল বাতাসের সাথে।
মীরা শেষমেশ মুক্তি পেল, আর শ্যামলী গ্রামে আর কখনও রহস্যময় নারীকে দেখা যায়নি।
### **শেষ কথা**
গ্রামের মানুষ অদিতির সাহসিকতা দেখে অভিভূত হয়েছিল। অদিতি প্রমাণ করল, সব রহস্যের পেছনে কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে, যা সাহস আর সহানুভূতির সাথে খুঁজে বের করতে হয়। মীরার কাহিনী শুধু অতীতের অংশ নয়, এটা ছিল ভালোবাসার প্রতি অবিচার, যা অবশেষে মুক্তি পেল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন