**এক রহস্যময় কুটির**
### **রহস্যময় কুটির**
বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়ছে, রোদ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। গ্রামের ছোট্ট পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটছিল তপন। সে ছিল শহরের ছেলে, কিন্তু কিছুদিন ধরে গ্রামে এসেছিল শান্তি খুঁজতে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এসে এই শান্ত, নির্জন গ্রামটা তাকে একদম মুগ্ধ করে ফেলেছিল। গ্রামের চারপাশে সবুজ মাঠ, নদীর ধারে বিশাল গাছপালা, আর বাতাসে এক ধরনের সোঁদা গন্ধ—সবকিছুই যেন তাকে এক অন্য জগতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল।
তবে এই গ্রামের একটা কৌতূহলজনক দিকও ছিল, যা তাকে আকর্ষণ করছিল—এক পুরনো, পরিত্যক্ত কুটির। গ্রামের সব লোকই কুটিরটা নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। লোকজন বলত, সেখানে একসময় একটা পরিবার থাকত, কিন্তু হঠাৎ করে সবাই উধাও হয়ে যায়। তারপর থেকে কুটিরটা কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। গ্রামের বাচ্চারা পর্যন্ত ওই কুটিরের ধারে কাছে যায় না। স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে, সেখানে কোনও অভিশাপ আছে।
তপন এসব গুজবে বিশ্বাস করত না। তার মনে হল, কুটিরটা পরিত্যক্ত হওয়ার পেছনে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, আজই সে কুটিরে যাবে এবং রহস্যটা উদঘাটন করবে।
#### **কুটিরের পথে**
তপন গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। সেখান থেকে সরু একটা পথ জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। সেই পথের শেষেই ছিল রহস্যময় কুটির। কুটিরটা দূর থেকে অন্ধকারে ঢেকে ছিল, যেন গাছপালার ছায়ায় মিশে গেছে। চারদিকে পাখিদের ডাকাডাকি আর হাওয়ার শব্দ ছাড়া কোনও আওয়াজ ছিল না। একটা অদ্ভুত শীতল অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল, কিন্তু সে স্থির রইল।
কুটিরের সামনে পৌঁছে তপন থমকে দাঁড়াল। বাড়িটা ছিল বেশ পুরনো, কিন্তু স্থাপত্যশৈলীটা অসাধারণ। পুরনো কাঠের দরজা, জানালাগুলো ভাঙা, আর ছাদে শ্যাওলা জমে গেছে। তার মনে হল, বাড়িটা যেন কত বছর ধরে পরিত্যক্ত পড়ে আছে। তপন ধীরে ধীরে কুটিরের দরজার কাছে গেল। দরজাটা বন্ধ ছিল, কিন্তু খিল ভাঙা। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
#### **ভেতরের অদ্ভুততা**
কুটিরের ভেতরটা একেবারেই অন্ধকার। তপন পকেট থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলে দেখল, ভেতরের পরিবেশ খুবই ভয়ঙ্কর। চারদিকে ধুলোর স্তর জমে আছে, মেঝেতে ইঁদুরের বিষ্ঠা ছড়ানো। কিছু পুরনো আসবাবপত্র এদিক-ওদিক ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। সবকিছু এতই চুপচাপ যে নিজের শ্বাসের শব্দটাও কানে বাজছিল।
তপনের চোখ মেঝের একটা কোণে থেমে গেল। সেখানে কিছু একটা চকচক করছে। সে কাছে গিয়ে দেখল, একটা পুরনো পিতলের বাক্স। বাক্সটার ওপর শ্যাওলা জমে আছে, কিন্তু সেটার হাতলের ওপর আঁকাবাঁকা লেখা কিছু অক্ষর আছে। তপন হাত বাড়িয়ে বাক্সটা তুলল। হঠাৎ করেই, একটা ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল, যেন কেউ তার পাশ দিয়ে চলে গেল। তার শরীর হিম হয়ে উঠল, কিন্তু সে ভয় পেয়ে পালাল না।
সে বাক্সটা খুলতে শুরু করল, কিন্তু সেটার ওপর কোনও তালা বা বন্ধনী ছিল না। ভেতরে সে দেখল কয়েকটা হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ, আর একটা পুরনো ছবি। ছবিটায় তিনজন মানুষ—একজন বয়স্ক পুরুষ, একজন নারী আর একটা ছোট মেয়ে। ছবির পেছনে লেখা, **"চিরকাল আমাদের পাশে থেকো"**।
#### **রহস্যের উন্মোচন**
তপন ছবিটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে দেখছিল, হঠাৎ করেই একটা কৌতূহলী আওয়াজ তার কানে এলো। যেন দূরে কোথাও ফিসফিস করে কথা বলছে কেউ। সে কৌতূহলী হয়ে চারদিকে তাকাল, কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। আওয়াজটা আবার এলো, এবার আরও কাছ থেকে। তপন সাহস করে আওয়াজের উৎসের দিকে এগোল। কুটিরের এক কোনায় একটা সিঁড়ি দেখা গেল, যেটা মাটির নিচে নেমে গেছে। মনে হল, কুটিরের নিচে একটা ভূগর্ভস্থ ঘর আছে।
তপন ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। মাটির নিচে একটা ছোট ঘর। ঘরটা ছিল আরও বেশি ভয়ঙ্কর—দেয়ালগুলোয় অদ্ভুত চিহ্ন, মেঝেতে মোমবাতির গলিত মোম। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, আর তার ওপর রাখা একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি।
তপন টর্চের আলো ফেলে পাণ্ডুলিপিটা খুলল। প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা ছিল, **"আমাদের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। কেউ একজন শয়তানকে ডেকেছিল।"** বাক্যটা পড়ে তপনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দ্রুত পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। ভেতরে লেখা ছিল, এই পরিবারের একজন সদস্য এক রাতে অদ্ভুত আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটা কালো শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল। তারপর থেকেই বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। একে একে পরিবারের সবাই নিখোঁজ হতে থাকে।
#### **আত্মার উপস্থিতি**
তপনের মন দুলে উঠল। সে জানত না, এগুলো কেবল গুজব না বাস্তব। হঠাৎ করেই, তার পেছনে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হলো—দরজা বন্ধ হওয়ার মতো আওয়াজ। সে দ্রুত পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। এবার তার শরীরে ভয়ের শীতলতা অনুভূত হতে লাগল।
আবার সেই ফিসফিস আওয়াজ। এবার আওয়াজটা একদম তার কানের কাছে।
"তুমি কেন এখানে এসেছ?"
তপন ভয়ে জমে গেল। সে দ্রুত কুটির থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু সিঁড়ির মুখে এসে থেমে গেল। তার সামনে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ থেকে যেন অন্ধকারের ছায়া বেরিয়ে আসছিল। সেই ছায়া একদম ঠান্ডা, তার শরীর যেন স্থির হয়ে গেল।
মূর্তিটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছিল।
"তুমি জানো না, তুমি কী খুঁজে পেয়েছ," মূর্তিটা ফিসফিস করে বলল। "আমাদের অভিশাপ এখনও শেষ হয়নি।"
#### **অভিশাপের আবেশ**
তপনের মনে হল, সে যেন কোনও দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়েছে। সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। তার শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল, কিন্তু তার মন এখনও কৌতূহলে ভরা। সে ভাবতে লাগল, "এটা কি সত্যিই ছিল? নাকি আমার মনের ভুল?"
বাইরে এসে তপন গ্রামের দিকে তাকাল। সূর্য একদম ডুবে গেছে, এবং চারদিকের অন্ধকার ক্রমেই বাড়ছে। কুটিরের ভেতরের সব ঘটনা যেন এখনও তার মনে দাগ কেটে আছে। সে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
তপন কুটির থেকে বেরিয়ে এলেও, তার মন কুটিরের অভিশপ্ত রহস্যের মধ্যে আটকে রইল।
কয়েকদিন পর, তপন সেই কুটিরের কথাটা একেবারে ভুলে যেতে চাইল। কিন্তু কুটিরের সেই ছায়ামূর্তি, সেই পুরনো পাণ্ডুলিপি, সেই অভিশপ্ত কাহিনী—সবকিছু যেন তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল।
#### **অন্তিম রহস্য**
একদিন সকালে, গ্রামের মানুষজন লক্ষ্য করল তপন হারিয়ে গেছে। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ঘরে কোনও চিহ্ন নেই, যেন সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কেবল তার টেবিলের ওপর সেই পুরনো পাণ্ডুলিপিটা পড়ে আছে, যেটা সে কুটির থেকে নিয়ে এসেছিল।
পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লেখা ছিল, **"আমাদের পাপ শেষ হয়নি। যে আমাদের ছোঁবে, সে আর কখনও ফিরবে না।"**
কুটিরের রহস্য এখনও অধরা, এবং তপন সেই রহস্যের চিরন্তন শিকার হয়ে গেল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন