গুপ্তধনের রহস্য



 ### গুপ্তধনের রহস্য


শ্যামলী গ্রামের এক প্রান্তে ছিল শতাব্দী প্রাচীন এক জমিদার বাড়ি, যার নাম ছিল "মহিমা মঞ্জিল"। বাড়িটি এখন ধ্বংসপ্রায়, শুধু পুরনো স্মৃতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের মানুষজন সেখানে যাওয়া থেকে সবসময় দূরে থাকত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল, জমিদার বাড়ির ভেতরে কিছু গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ বলত, সেখানে গুপ্তধন লুকানো আছে। তবে জমিদার পরিবারের সব সদস্য অনেক বছর আগে মারা যাওয়ার পর থেকে কেউ এই বাড়ির মালিকানা দাবি করতে আসেনি। 


এই গল্পের শুরু হয় তখন, যখন গ্রামের এক যুবক, অজয়, পুরনো মহিমা মঞ্জিলের গুপ্তধনের রহস্য উদ্ঘাটনের সিদ্ধান্ত নেয়। তার বাবা-মা ছোটবেলায় মারা যাওয়ার পর থেকে অজয় একাই বড় হয়েছে। তার জীবনে বড় কোনো সম্পদ ছিল না, শুধু ছিল এক অসীম কৌতূহল আর রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। 


#### **প্রথম ইঙ্গিত**


একদিন গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত, পুরনো পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে হঠাৎ করে একটি তথ্য আবিষ্কার করেন। পাণ্ডুলিপিতে মহিমা মঞ্জিলের কোনো এক গুপ্তধনের উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা ছিল, "গুপ্তধন সেই পাবে, যে জানবে পথের সংকেত আর শুনতে পাবে মাটির নিচে চাপা পড়া কণ্ঠ।"


পুরোহিত বিষয়টি গ্রামের কিছু মানুষকে জানালেও তারা তেমন গুরুত্ব দিল না। কিন্তু অজয় এই সংবাদ শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে ভাবল, "এটাই আমার জীবনের সুযোগ। যদি আমি সত্যিই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যাই, তাহলে আমার সব দুঃখ ঘুচবে।"


#### **মহিমা মঞ্জিলে প্রথম প্রবেশ**


অজয় এক রাতে চুপচাপ মহিমা মঞ্জিলের দিকে রওনা দিল। ভাঙা গেট পেরিয়ে, সে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভাঙাচোরা মেঝে, ধুলোমাখা জানালা, আর পুরনো আসবাবপত্র যেন এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই সে অনুভব করল, যেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। 


বাড়ির এক কোনায় ছিল পুরনো লাইব্রেরি। অজয় ভেতরে ঢুকে সেখানে রাখা পুরনো বইগুলো ঘাঁটতে লাগল। বইগুলোর বেশিরভাগই ধুলোর নিচে চাপা পড়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎ সে এক পুরনো মানচিত্র খুঁজে পেল। মানচিত্রটিতে মহিমা মঞ্জিলের নিচের তলায় একটি গোপন কক্ষের উল্লেখ ছিল। কক্ষটি বাড়ির পেছনের দিকে কোথাও লুকিয়ে ছিল, এবং সেখানে যাওয়ার জন্য বিশেষ একটি সংকেতের প্রয়োজন ছিল।


#### **রহস্যময় সংকেত**


অজয় মানচিত্র দেখে ঠিক করল, সে সেই গোপন কক্ষের সন্ধান করবে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার জন্য দরকার ছিল সংকেত। মানচিত্রে লেখা ছিল, "তিনটি ধাপ পেরোতে হবে—প্রথম ধাপে আলো, দ্বিতীয় ধাপে ছায়া, আর তৃতীয় ধাপে মাটি তোমার পথ দেখাবে।" 


এই ধাঁধার অর্থ বোঝা সহজ ছিল না। অজয় কয়েকদিন ধরে মহিমা মঞ্জিলের আশপাশে ঘুরে বেড়াল, বাড়ির প্রতিটি অংশ খুঁজে দেখল। একদিন হঠাৎ, বাড়ির পেছনের বাগানে একটি পুরনো পাথরের মূর্তি খুঁজে পেল, যা অনেকদিন ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। 


মূর্তির ওপর সূর্যের আলো পড়ার সাথে সাথেই, মূর্তির চোখে কিছু ঝলকানি দেখা দিল। অজয় ভাবল, "এটাই সেই প্রথম ধাপ—আলো।" মূর্তির পেছনে মাটিতে কিছু পাথরের সিঁড়ি ছিল, যেগুলো ছায়ার আড়ালে ছিল। অজয় বুঝতে পারল, দ্বিতীয় ধাপটি এই ছায়ার মধ্য দিয়েই যাবে।


#### **গোপন কক্ষে প্রবেশ**


পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে অজয় একটি অন্ধকার করিডোরে পৌঁছাল। করিডোরটি ছিল সরু ও ভয়ঙ্কর, এবং চারদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। করিডোরের শেষে সে একটি পাথরের দরজা দেখতে পেল, যা অনেক পুরনো ছিল। দরজার গায়ে খোদাই করা ছিল কিছু অজানা লিপি।


অজয় মানচিত্রের নির্দেশনা অনুসারে দরজার ওপরে হাত রাখল। তখনই দরজাটি এক মৃদু শব্দ করে খুলে গেল। ভেতরে ছিল এক গোপন কক্ষ। কক্ষটি ছিল ছোট, কিন্তু সেখানে একটি পুরনো কাঠের বাক্স রাখা ছিল। বাক্সটির চারপাশে কয়েকটি মোমবাতি ছিল, যদিও এতদিন ধরে মোমবাতিগুলো নিভে গেছে। 


অজয় যখন বাক্সটি খোলার জন্য হাত বাড়াল, তখনই হঠাৎ করে কক্ষের ভেতর থেকে এক প্রবল বাতাসের ঝাপটা এল। সে পেছনে সরে গেল। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বাক্স খোলার থেকে বিরত করার চেষ্টা করছিল।


#### **অদ্ভুত কণ্ঠস্বর**


ঠিক সেই মুহূর্তে, অজয় শুনতে পেল একটি মৃদু কণ্ঠস্বর। কণ্ঠটি যেন মাটির নিচ থেকে ভেসে আসছে। কণ্ঠটি বলছিল, "গুপ্তধন তার নয়, যে শুধু সম্পদের লোভ করে। সত্যিকার অধিকারীকে এটি পেতে হলে নিজের সাহস ও বিশ্বাসের প্রমাণ দিতে হবে।" 


অজয় বিস্মিত হয়ে চারদিকে তাকাল, কিন্তু কণ্ঠটি কোথা থেকে আসছে, সে বুঝতে পারল না। কণ্ঠটি আরও বলল, "তুমি যদি সত্যিই এই গুপ্তধনের অধিকারী হতে চাও, তাহলে তোমাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।"


অজয় এবার বুঝল, এই গুপ্তধন শুধু তার জন্য নয়, যে শুধু অর্থের লোভ করে। এর পেছনে আরও বড় কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে। সে সাহস করে আবারও বাক্সটির দিকে এগিয়ে গেল এবং ধীরে ধীরে ঢাকনাটি খুলল।


#### **গুপ্তধনের আবিষ্কার**


বাক্সটি খুলতেই অজয়ের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ভেতরে কয়েকটি প্রাচীন মুদ্রা, কয়েকটি স্বর্ণালঙ্কার, আর একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি রাখা ছিল। মুদ্রা আর স্বর্ণালঙ্কার দেখে অজয় প্রথমে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তবে পাণ্ডুলিপিটি দেখে তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল।


সে পাণ্ডুলিপিটি খুলে দেখল, সেটি ছিল জমিদার পরিবারের ইতিহাস, এবং সেখানে লেখা ছিল সেই গুপ্তধনের আসল রহস্য। জমিদার পরিবারটি বহু বছর ধরে এই সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল, কারণ তারা বিশ্বাস করত যে এই ধন সম্পদ গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাদের হঠাৎ মৃত্যুর কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।


পাণ্ডুলিপিতে আরও লেখা ছিল, "এই সম্পদ যে পাবে, তার দায়িত্ব হবে গ্রামের মানুষের কল্যাণে এটি ব্যবহার করা। অন্যথায়, এই সম্পদ শাপ হিসেবে তার জীবনে নেমে আসবে।"


#### **অজয়ের সিদ্ধান্ত**


অজয় এবার বুঝতে পারল, এই সম্পদ তার জন্য নয়, শুধুমাত্র তার লোভ মেটানোর জন্য। সে জানত, যদি সে শুধু নিজের জন্য এটি ব্যবহার করে, তাহলে শাপ তার জীবনে নেমে আসবে। পাণ্ডুলিপির নির্দেশনা অনুযায়ী, সে ঠিক করল, এই ধন সম্পদ গ্রামের কল্যাণে ব্যয় করবে।


পরের দিন, অজয় গ্রামের প্রধানদের কাছে সব কথা খুলে বলল। গ্রামের মানুষ প্রথমে অবিশ্বাস করলেও, অজয়ের দেখানো প্রমাণ দেখে তারা বিশ্বাস করল। সবাই মিলে ঠিক করল, এই ধন সম্পদ দিয়ে গ্রামের উন্নতি করা হবে—নতুন স্কুল, হাসপাতাল, আর কৃষিক্ষেত্র তৈরি করা হবে।


#### **শেষ কথা**


অজয় নিজের লোভকে পরাস্ত করে একটি মহৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার এই কাজের জন্য গ্রামবাসীরা তাকে সম্মানিত করল। গুপ্তধনের রহস্য শুধু একটি ধনসম্পদের কাহিনী ছিল না, এটি ছিল নৈতিকতার, সাহসিকতার, আর মানবকল্যাণের প্রতীক। 


অজয়ের এই আবিষ্কার শুধু তার জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দিল না, পুরো গ্রামের জীবনধারাকেই বদলে দিল। মহিমা মঞ্জিলের গুপ্তধন এখন আর শুধু রহস্য নয়, এটি হয়ে উঠল গ্রামের সমৃদ্ধির প্রতীক।



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ