অন্ধকারের অন্তরালে

 ### **অন্ধকারের অন্তরালে**


অদ্ভুত, রহস্যময় এবং সব সময় নিঃশব্দে থাকা এক কিশোর, অর্জুন। বয়স মাত্র তেরো, কিন্তু তার চোখে এমন এক অদ্ভুত ঝিলিক ছিল যা তার সমবয়সীদের মধ্যে দেখা যেত না। সে খুব একটা কথা বলত না, বন্ধু-বান্ধবও খুব কম ছিল। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে মিশতে চাইত না, কারণ তারা সবাই বিশ্বাস করত যে অর্জুনের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। কিছু একটা, যা অন্ধকারে ঢাকা। তবে অর্জুন কখনো কাউকে পাত্তা দিত না। সে ছিল নিজের জগতে মগ্ন, যেখানে সবকিছু ছিল জটিল এবং গভীর।


অর্জুনের মধ্যে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল—সে ছোটবেলা থেকেই রহস্যের প্রতি খুব আকৃষ্ট। একটানা সময় কাটাতো বিভিন্ন রহস্যময় বই পড়ে, পুরনো পত্রিকায় অদ্ভুত কেসের গল্প খুঁজে বেড়াত। কিন্তু এ সবই যেন তাকে পরিপূর্ণ করত না। তার মনে হত, সে এমন কিছু একটা খুঁজছে যা তার বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তাকে নিজের পরিচয় সম্পর্কে সত্য উদঘাটনে সাহায্য করবে। 


#### **অদ্ভুত অনুরণন**


একদিন বিকেলে, গ্রামের বাইরে একটু দূরে একটা পুরনো বাড়ির সামনে সে এসে দাঁড়াল। বাড়িটা ছিল বিশাল, তবে সম্পূর্ণ ভগ্নপ্রায়। তার দাদু এই বাড়ির কথা অনেকবার বলেছিলেন, কিন্তু অর্জুন কখনো সেখানে যাওয়ার সাহস করেনি। লোকেরা বলত, বাড়িটা অভিশপ্ত। আর অভিশপ্ত জায়গাগুলো অর্জুনকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করত।


সে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির জানালাগুলো সব বন্ধ, বাইরের দেয়ালগুলো ধুলোতে ঢেকে আছে। তবে তার চোখে এক অদ্ভুত কৌতূহল দেখা দিল। "এখানে নিশ্চয়ই কিছু লুকিয়ে আছে," অর্জুন নিজেকে বলল। 


কিছুক্ষণ চারপাশে ঘুরে বাড়ির পেছনের দিকে গেল। একটা ভাঙা দরজা পেল, যেটা কিছুদিন আগেই কেউ খুলেছে, এর প্রমাণ ছিল মাটিতে পড়ে থাকা কিছু দাগ। ভেতরে ঢুকলেই সে টের পেল, বাড়ির ভেতরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বদ্ধ, স্যাঁতসেঁতে বাতাস, এবং এক অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ ভাসছিল চারদিকে। যেন বাড়িটা দীর্ঘদিন ধরে কিছু একটা গোপন করে রেখেছে, যেটা আলোতে আসার অপেক্ষায়।


অর্জুন এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল, পায়ের শব্দ তার নিজের কানে ধাক্কা মারছিল। হঠাৎ, একটা ঘরের ভেতর থেকে মৃদু ফিসফিসানি শোনা গেল। অর্জুনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল, কিন্তু সে পিছিয়ে এল না। বরং শব্দটার উৎসের দিকে এগিয়ে গেল। ঘরটা ছিল আধো অন্ধকার, ধুলোতে ভরা। একটা পুরনো আলমারি, যেটার দরজা আধখোলা, তার দিকেই শব্দটা আসছে।


সে আলমারির কাছে গেল এবং দরজাটা খুলে দিল। ভেতরে কিছু পুরনো কাগজপত্র পড়ে ছিল, আর সেগুলোর মধ্যে ছিল একটা ছোট্ট লাল ডায়েরি। ডায়েরিটা ছিল পুরনো, পাতাগুলো হলদেটে, তবে কৌতূহলী কিছু একটা ছিল সেটার ভেতরে। অর্জুন ডায়েরিটা হাতে তুলে নিল। 


#### **অন্ধকারের গল্প**


ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় লেখা ছিল, "অন্ধকার সবকিছু গ্রাস করে। কিন্তু কখনো কখনো অন্ধকার নিজেই কিছু লুকিয়ে রাখে।"


অর্জুনের মনজুড়ে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ডায়েরির পাতাগুলোতে এক অজানা ভাষায় কিছু লেখা ছিল, তবে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা পুরনো কাহিনী—একটা অভিশপ্ত পরিবারের গল্প। সেই পরিবারের ছোট ছেলে, যার নাম ছিল রণজিত, নাকি একদিন রাতে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ জানত না কোথায় গেল সে। তার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে, পরিবারটা ভেঙে পড়ে। বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে, যেন বাড়িটাই অভিশপ্ত হয়ে গেছে।


ডায়েরির শেষ দিকে এসে অর্জুনের দৃষ্টি আটকে গেল একটা ছবিতে। ছবিটায় রণজিতের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—একটা ছোট্ট ছেলে, ঠিক তারই বয়সী, কিন্তু তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত ঠান্ডা দৃষ্টি। ছবির নিচে লেখা ছিল, "যে ফিরে আসেনি, সে সবসময় ফিরে আসতে চায়।"


#### **প্রতিধ্বনি**


অর্জুনের মন ভয়ে এবং কৌতূহলে ভরে উঠল। বাড়িটা যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠল। তার মনের ভেতর যেন কোন এক ছায়া ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছিল। 


ডায়েরিটা পড়ার পর থেকেই অর্জুনের মনে অদ্ভুত অস্থিরতা বাসা বাঁধল। রাতের বেলা সে ঘুমাতে পারত না। একটা ঠান্ডা, অদ্ভুত শীতল অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ঘুমের মাঝে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগল সে। প্রতিবার সেই পুরনো বাড়ির মধ্যেই নিজেকে দেখতে পেত, আর প্রতিবার বাড়ির ভেতরকার ছেলেটার চোখের দিকে তাকালেই সে হঠাৎ জেগে উঠত, ঘামে ভেজা অবস্থায়।


তার মনে হল, ডায়েরির ভেতর যা লুকানো আছে, সেটা শুধু একটা গল্প নয়। কিছু একটা বাস্তব আছে এই রহস্যের মধ্যে, যেটা সে অন্ধকারের গভীরে গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে।


#### **ভয়ের শুরু**


একদিন গভীর রাতে, অর্জুন সিদ্ধান্ত নিল যে সে আবার সেই বাড়িতে যাবে। এবার সে আরও প্রস্তুত ছিল। একটা ছোট্ট টর্চলাইট এবং পকেটে কয়েকটা চাবি নিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে সে সরাসরি সেই ঘরটার দিকে এগোল, যেখানে সে ডায়েরিটা পেয়েছিল। কিন্তু এবার ঘরটা সম্পূর্ণ আলাদা মনে হল। 


ঘরের কোণ থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছিল, যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। অর্জুন ভয়ে পিছিয়ে এল, কিন্তু আবার সেই কৌতূহল তাকে টেনে নিল সামনে। শব্দটার উৎস খুঁজতে গিয়ে সে একটা গোপন দরজা আবিষ্কার করল, যেটা দেয়ালের মধ্যে লুকানো ছিল। সে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা সহজে খুলছিল না। প্রচুর চেষ্টার পর দরজাটা খোলার সাথে সাথে সে দেখল, ভেতরে একটা অন্ধকার সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির নিচে।


অন্ধকার সিঁড়ি, ভাঙা দেয়াল, ধূলোময় পরিবেশ—সবকিছুই যেন তাকে থামতে বলছিল। কিন্তু অর্জুন থামল না। সে এগিয়ে চলল। তার মন তাকে কেবল একটা কথাই বলছিল, "তুমি কাছাকাছি চলে এসেছ, পিছিয়ে যেও না।"


#### **অবশেষের দ্বারপ্রান্তে**


সিঁড়ির নিচে নেমে একটা ছোট্ট কক্ষের ভেতর ঢুকল অর্জুন। কক্ষটা ছিল খুব পুরনো, মাটির দেওয়ালে খোদাই করা কিছু অদ্ভুত চিহ্ন ছিল, যা সে বুঝতে পারছিল না। কক্ষের মাঝখানে ছিল একটা ছোট্ট টেবিল, আর তার ওপরে রাখা ছিল একটা পুরনো বাক্স। অর্জুনের চোখ তখন শুধু সেই বাক্সটার ওপর আটকে ছিল।


বাক্সটার কাছে গিয়ে সে ধীরে ধীরে ঢাকনাটা তুলল। ভেতরে ছিল কিছু পুরনো কাগজপত্র এবং একটা ছোট আয়না। কিন্তু সেই আয়নাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখার বদলে, অর্জুন দেখল আরেকটা ছেলে—রণজিত! 


ছেলেটার মুখে এক অদ্ভুত হাসি ছিল। 


“তুমি আমাকে খুঁজে পেয়েছ,” বলল ছেলেটা। “কিন্তু জানো, আমিই তো তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।”


অর্জুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তা ঘুরছিল। কীভাবে সম্ভব? 


রণজিত আবার বলল, “তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, তাই না? কারণ আমি তোমারই অংশ। সেই দিন থেকে, যেদিন তুমি আমার জায়গায় এসেছিলে।” 


#### **মনের গভীরে লুকানো সত্য**


এতদিন ধরে অর্জুন যা অনুভব করছিল, তা কোনো অজানা রহস্য ছিল না। সে নিজেই সেই রহস্যের কেন্দ্রে ছিল। সে আর রণজিত আলাদা নয়—ওরা একই। সেই পুরনো দিনের কোন এক

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ